এক বিষন্ন বিকেলে (সম্পুর্ণ ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:৩৮:১১ দুপুর
বাটালি হিলের সব থেকে উঁচুতে টাওয়ারের কাছে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে।আশেপাশে এই মুহুর্তে কেউ নেই। থাকলেও সে দেখতে পেত কিনা সন্দেহ। এখন কোনো কিছু দেখার মত অবস্থায় আসলে সে নেই। কিছুক্ষণ পর যে জীবনটাকে সে শেষ করে দিতে যাচ্ছে, সেই দেহের ভিতরের 'কোনো কিছু দেখে' বা উপলব্ধি করে যে অর্গানটি, সেটা এই মুহুর্তে ভীষণ ডিস্টার্বড... বড় বেশী এলোমেলো!
সুইসাইডের অনেক পথ থাকলেও এই উপর থেকে পড়েই থেতলানো মৃত্যু তার কাছে সহজ মনে হয়েছে।
সহজ?
মৃত্যুকে যেন সে কত অনুভব করেছে! তবে ইদানিং এতোটা নীচে সে নেমে গেছে যে, শেষ যাত্রাটা সে অনেক উপর থেকে শুরু করতে চায়। একটা প্রচন্ড গতি যেন সব কিছুকে শেষ করে দেয়। আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। আর কয়েক পা এগোলেই এই জীবনের সমাপ্তি। শেষবারের মতো এতো উপর থেকে ওর প্রিয় শহরটিকে দেখে।
আহ! কত সুন্দর এই শহর। এখান থেকে পুরো চট্টগ্রামকে দেখা যায়।
ওর শহর... যেখানে মিজানকে নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে... কত টুকরো টুকরো স্মৃতি, আনন্দঘন মুহুর্ত!!
আর এরপরে বিষাদের এক ঝড়ো হাওয়া আজ ওকে এই পাহাড়চূড়ায় টেনে এনেছে সব খেলা শেষ করে বাড়ী ফেরার জন্য। তবে এর জন্য যে সে নিজেই দায়ী।
এটা বুঝতে পারছে বলেই এতো সহজে সব কিছু মেনে নিয়েছে রুনা।
নাফিসের সাথে বেশ ঘটা করেই রুনার বিয়েটা হয়েছিল। ওদের বন্ধু সার্কেলেই ছিল নাফিস। অবশ্য পড়ালেখাটা একসাথে করেনি অন্যদের মত। সে ছিল আলাদা। চিটাগং কলেজের। আর রুনার সকল বান্ধবীরা নাসিরাবাদ উওমেন কলেজের। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মিজানের সাথে পরিচয়ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিচয়... বন্ধুত্ত এবং এই দুটোর গন্ডী ছাড়িয়ে আরো অনেক কিছুই ছিল মিজানের সাথে। জীবনের অনেক 'প্রথম কিছু' রুনা মিজানের সাথে শেয়ার করেছে।হৃদয়ের সাথে সাথে শরীরের লেনদেনও হয়েছে দুজনের ইচ্ছেতেই। সেখানে তখন মনের সায়টাই ছিল বেশী।
সবকিছুই ঠিকমত চলছিল। অন্য সবার মত নাফিসও রুনা-মিজানের প্রেমের কথা জানত। বন্ধুদের আড্ডায় সেও থাকত। তখন তো ওর ভিতরে রুনা কোনোরকম ইর্ষা বা অন্য ধরণের গোপন ইঙ্গিত দেখতে পায়নি। তবে রুনার আব্বার স্ট্রোক এর পরে তিনি একমাত্র মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। এর ভিতরে রুনা ভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে একটি বেসরকারী সংস্থায় জয়েন করেছে। কিন্তু মিজান তখনো পর্যন্ত কোনো জব যোগাড় করতে পারেনি। সেদিক থেকে নাফিস ওদের পারিবারিক ব্যবসাটা সেই চিটাগং কলেজ থেকে মাস্টার্স করার পর দেখে আসছিল। রুনারা সেসন জটে আটকে থেকে চার বছরের কোর্স আট বছরে শেষ করে যখন বের হল, নাফিস তখন একজন সফল বিজনেসম্যান হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
একদিন পারিবারিকভাবেই রুনা ও নাফিসের বিয়েটা হয়ে গেলো।
মিজান শুধু বুকে কষ্ট নিয়ে বন্ধু হিসাবে ওর বিয়েতে অন্যদের সাথে এলো... হাসি-ঠাট্টার ভিতর দিয়ে নিজের কষ্টকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টায় মেতে রইলো। তবে সবাই বুঝতে পারলেও এটা এমন এক বাস্তবতা যে কারো কিছু করার ছিল না। মিজানের চোখের সামনে দিয়ে রুনা নাফিসের হাত ধরে নতুন জীবনে প্রবেশ করল।
কষ্ট কি রুনার ও কম হয়েছিল সেদিন?
কিন্তু ওর আব্বার কথা চিন্তা করে সে নিশ্চুপ থেকেছিল। বিয়ের দিনেও... কথা পাকা হবার সময়গুলোতেও। না হলে সে ইচ্ছে করলে মিজানকে নিয়ে কোর্টে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু বাবা-মেয়ে এবং প্রেমিক-প্রেমিকা'র ভিতরের ভালবাসাটা নিক্তির বিচারে বাবা'র দিকে একটু বেশী হেলে পড়ায় সে নাফিসের সংসারকেই বেছে নিয়েছিল।
প্রায় আট বছর কাটিয়ে দিল নাফিসের সাথে। এই দীর্ঘ সময়টাতে নাফিস কখনো ওর আর মিজানের সম্পর্ক নিয়ে কোনো ধরণের কথাই বলেনি। না কোনো কঠাক্ষ কিংবা অনুযোগ। তবে রুনা এখন পর্যন্ত নাফিসকে মনের দিক থেকে মেনে নিতে পারে নাই। একজন স্ত্রী হিসেবে নাফিসের যত না কাছে এসেছে, একজন দেহপসারিণীর ভুমিকাই বেশী নিয়েছে সে। একটু থেমে গেল রুনা এই চিন্তাটা মাথায় আসাতে।
কেন এভাবে ভাবছে সে?
এতোটা চিন্তার দৈন্যতা ওর ভিতরে কেন?
হয়ত মনের মিল ওদের ভিতর ছিল না... ওদের না বলে ওর নিজের ছিল না। নাফিস কখনোই ওকে অবহেলা করে নাই। বরং সে ই নাফিসকে দূরে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছে। একজন পুরুষ যখন একই বিছানায় একজন যুবতির সাথে থাকে... আর সে যদি তার বউ হয়- কিভাবে জৈবিক দেনাপাওনা থেকে বিরত থাকতে পারে। কিন্তু রুনা অসংখ্য রাত নাফিসকে শরীর ভালো লাগছেনা কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। অথচ নাফিস এতোটাই ভদ্র যে ফিরে গেছে, কিন্তু ঠোটের কোনায় হাসিটাকে পর্যন্ত মলিন হতে দেয় নাই। আর এই আট বছরে যে ক'বার ওদের ভিতরে কিছু হয়েছে, সেই উত্তাল সময়গুলোতে রুনার মন ও মগজে নাফিসের পরিবর্তে মিজানই বিরাজ করেছিল।
মাথার উপর দিয়ে কর্কশ শব্দ করে একট নাম না জানা কি পাখী উড়ে গেল। রুনার ধ্যান ভেঙ্গে যায়। বিকেলটাকে আরো মলিন মনে হচ্ছে এখন। একটু হাসে সে। এটাই ওর জীবনের শেষ বিকেল। সেটা আলোকোজ্জ্বল হলেই বা কি যায় আসে? আচ্ছা ফাঁসির আসামিকেও তো তার শেষ যে কোনো একটা ইচ্ছে পুরণ করার সুযোগ দেয়া হয়। তার নিজের কি কোনো শেষ ইচ্ছে আচ্ছে? এটা ভাবতেই একটা হাহাকার নতুন করে আবার ওকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। একটা ডাক শোনার ওর বড় ইচ্ছে!!!
কিন্তু...
বিয়ের আটবছরেও রুনা-নাফিস দম্পতি একটি সন্তানের মা-বাবা হতে পারলনা। প্রথম দু'বছর তো সবাই জীবনের রুপ-রস উপভোগে কাটিয়ে দেয়। এরপর শরীরটা একটু ঠান্ডা হলে তৃতীয় একটি সত্তার ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। তবে যখন একটি তুলতুলে হাতের সাথে খেলা করার বাসনাটা নাফিস প্রকাশ করল, এরপর অনেক চেষ্টা করেও ওরা দুজন সফল হলনা। কিছুটা হতাশ এবং অজানা শংকায় নাফিস ওকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে রুনা রাজী হল না। কোনোভাবেই ওকে নাফিস রাজী করাতে পারল না। তবে এ ব্যাপারে রুনা কোনো ধরণের এক্সপ্লানেশন ও দিতে চাইলনা।
কেটে গেল আরো কয়েকবছর।
এর ভিতরে একদিন রুনার এক ডাক্তার বান্ধবীর সাথে মিমি'র সামনে দেখা হয়। অনেকদিন পরে দুই পুরনো বান্ধবীতে দেখা হওয়াতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হল। রুনা ওকে ওর বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে কথায় কথায় এই সন্তানের প্রসঙ্গ চলে আসে। রুনাকে বান্ধবীর ক্লিনিকে পরেরদিন নাফিসকে সহ যেতে বলে সেদিন বিদায় নেয়। পরেরদিন রুনা একা সেখানে হাজির হয়। বান্ধবীকে জানায় নাফিস ব্যবসার কাজে কয়েকদিনের জন্য ঢাকাতে। বান্ধবীও আর এ ব্যাপারে প্রশ্ন না করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো করে নেয়। সেদিন চলে আসে রুনা।
দুদিন পরে সেই ডাক্তার বান্ধবীর কল আসে ওর মোবাইলে। ক্লিনিকে আসতে বলে।সেখানে গিয়ে জানতে পারে একজন মা হবার জন্য তার কোনো শারীরিক সমস্যা নেই। তারমানে সমস্যাটা কি তবে নাফিসের? বান্ধবী জানায় নাফিসকে পরীক্ষা করতে পারলে ওদের একটা সমাধান হয়ত বের করা যেতে পারে। একই সাথে মনের ভিতর আনন্দ ও বেদনা নিয়ে রুনা ক্লিনিক থেকে বের হয়।
এবং মিজানের সাথে বিচ্ছেদের প্রায় সাত বছর পর ক্লিনিক থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে গেল। দুজনেই দুজনকে চিনল। মিজান আগের থেকে আরো সুন্দর হয়েছে। মিজান এর চোখেও রুনাকে আগের থেকে আকর্ষনীয় লাগল। মিজান ওর মোবাইল নাম্বার দিয়ে চলে গেলো। সে একটা জরুরী কাজে বের হয়েছিল। তবে এতোগুলো বছর পর দুজন মানুষ যারা একজন অপরজনকে পাগলের মত ভালবাসত, তাদের দেখা হলে কেন যেন আগের সেই সহজ সম্পর্ক থাকেনা। দুএকটা কথা বলেই দুজন চুপ করে গেল। রুনা যে এতগুলো বছর তার চিন্তা চেতনায় মিজানকে সযত্নে লালন করেছে... একেবারে একান্ত সময়গুলোতেও, সেও পর্যন্ত কি বলবে বুঝতে পারলনা।
মিজানকে দেখে একটা নতুন দুঃস্বপ্ন রুনার কল্পনায় উঁকি দিতে লাগল। সে নাফিসের শারীরিক অক্ষমতার কথাটা জানাবে না ঠিক করল। সেই রাতেই মিজানকে ফোন করল। মিজানের ওয়াইফ ফোন রিসিভ করে। রুনাকে জানালো মিজান ড্রয়িংরুমে মেয়েকে নিয়ে আছে। রুনার সাথে বেশী কথা না বলে মিজানকে ফোনটা দিয়ে দিল। মামুলি দু'একটা কথা বলে সেদিনের মত ফোন রেখে দিল মিজান। এরপর সময় অসময়ে রুনা মিজানকে ফোন করেছে। কি অফিসে কি বাসায়- সব সময়েই রুনা ওদের বিয়ের আগের সম্পর্ককে নতুন করে নিয়ে আসতে মিজানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অথচ মিজান ওকে ভদ্রভাবে এখন আর সেটা সম্ভব নয় সেটা বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু রুনার মনে তখন একটা গোপন বাসনা প্রকাশ্যে আসি আসি করছে। সেটা সে সরাসরি মিজানকে জানিয়েও দিল।
মিজানের সাথে ফেসবুকে অ্যাড হল... ওদের পুরনো বন্ধুদের একটা গ্রুপ আছে যেখানে মিজান আগে থেকেই রয়েছে, সেখানেও রুনা অ্যাড হল। পুরনো বন্ধুদের সবাইকে ফেসবুকের কল্যাণে কাছে পেলো। তবে রুনার বিভিন্ন পোস্ট অন্যদেরকে কিছুটা বিব্রত করা শুরু করল যখন মিজানের একান্ত কিছু ব্যাপার নিয়ে সে গ্রুপে এবং মিজানের টাইমলাইনে লিখতে শুরু করল। তবে রুনার কিছুটা খ্যাপা স্বভাবের কথা বন্ধুরা আগে থেকেই জানত বলেই কেউই তেমন সিরিয়াস ভাবে নিলোনা। তবে এর ভিতরে যা হবার তা হয়েই গেছে। মিজানও কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ল রুনার প্রতি। এর কারণও ছিল। রুনা মিজানকে বুঝিয়েছিল যে, নাফিস বিয়ের পর থেকে মিজানের সাথে বিয়ের আগের সম্পর্কের কারণে রুনাকে বিভিন্ন ভাবে মেন্টাল টর্চার করে আসছে। এমনকি শারীরিক সম্পর্কের সময়গুলোও বাদ দেয় না। এভাবে আরো অনেক কাল্পনিক কাহিনী সে মিজানকে বিভিন্ন সময়ে শুনিয়ে ওর প্রতি আরো দুর্বল করে দিলো। আর রাতের পর রাত দুজনে ইনবক্সে চ্যাট করতে থাকল। দিনের বেলায়, অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকেও। একটা সর্বগ্রাসী সেক্সুয়াল চাহিদা আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে মিজানকে গিলে খেতে লাগলো। প্রথম দিকে দুষ্টুমির আদলে এর সুত্রপাত। স্রেফ কথার পিঠে কথার রিফ্লেক্সে মিজান সাড়া দিতে থাকে। আর নিজের অজান্তে কখন যে পংকিলতার গভীরে ডুবে যেতে থাকল সেটা মিজান অনুধাবন করতে পারলেও ফিরে আসতে পারছিল না। একদিকে মিজানের বউ ও মেয়ের জন্য অত্যধিক ভালবাসা এবং রুনার সাথে এই বিবাহ-বহির্ভুত সেক্সুয়াল আলাপ আলোচনা যার দ্বারা ওদের দুজনকে ঠকানো হচ্ছে... একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন ধীরে ধীরে ধবংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
গ্রুপের অন্য বন্ধুরাও কিছু একটা আঁচ করতে পেরে মিজানকে কয়েকবার সাবধানও করেছিল। কিন্তু রুনার সাথে চ্যাট এবং সকলের অগোচরে বাহিরে মেলামেশা করার জন্য মিজান এক অদৃশ্য জালে আটকে গিয়েছিল যেটাকে সে মায়া মনে করে আগাচ্ছিল। একদিন রুনা মিজানকে বলল,
: আমাকে একটা বাবু দাও? - মিজান অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। জিজ্ঞেস করল,
: মানে? কি বুঝাতে চাইছ?
: সরাসরি বললে আই ওয়ান্ট টু স্লিপ উইথ ইউ। আমাকে একটা বাচ্চা দিবে তুমি। নাফিসের সে ক্ষমতা নেই।
এটা শুনে কিছুটা ঘৃণায়... কিছুটা আহত হয়ে বিস্ময় মাখানো দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ রুনার দিকে চেয়ে রইলো মিজান। তবে সেদিন আর কোনো কথা না বলে দুজন যার যার বাসায় চলে এলো।
এরপর আরো কয়েক মাস কেটে গেলো।
একদিন বিকেলের দিকে মিজানের মোবাইলে রুনার কল এলো। কিছুটা বিরক্ত হয়ে সে ফোন রিসিভ করল। রুনা মিজানকে এখুনি ওর বাসায় আসতে বলল। ওর নাকি খুব একটা সমস্যা হয়েছে। আর নাফিসও তখন চিটাগঙ্গে নেই। রুনারা বাসায় এই দুজনই থাকে।একটি ছুটা কাজের বুয়া প্রতিদিন কাজ করে চলে যায়। কোনো কিছু না ভেবেই মিজান অফিস থেকে চলে এলো রুনার ফ্ল্যাটে। কলিং বেলের আওয়াজে রুনা নিজে এসে দরোজা খুলে দিলো। অবাক মিজান ঘরের ভিতরে প্রবেশ করল।
এরপর...
কিছুটা দমবন্ধ লাগাতে রুনা পাহাড়ের উপরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু হাঁটলে মনে হয় ভালো লাগবে। কয়েক পা হেঁটেই থেমে গেলো। সে না এখানে এসেছে মরে যেতে। তবে দমবন্ধ হলেই বা কি? কেন বাতাসের খোঁজ করছে। আবার ঘাসের উপরে বসে পড়ল। সেদিনের কথা ভাবছে। মিজান ওর কথা শুনে ওর ফ্ল্যাটে আসার পরে সে সোজা মিজানকে জড়িয়ে ধরে। একজন ভুতপুর্ব প্রেমিকার এহেন আচরণ মিজানকে বিহ্বল করে সেয়। কিন্তু একটা বন্ধ ঘরে একা একজন পুরুষ এক কামুক নারীর বাহুবন্ধনে আবদ্ধ... যে তারই একসময়ের ধ্যান-জ্ঞান ছিল। আর নারী চাইলে কোনো পুরুষ কেন, কোন দেবতারও সাধ্য নেই তার থেকে ফিরে আসে! মড়ালও এক পলকের জন্য নিজেকে বিস্মৃত হল... সে ফিরে গেলো আট বছর আগের এক সময়ে... ধীরে ধীরে ধ্বংসের এক অতল গহ্বরে সে হারিয়ে যেতে থাকল...
যেভাবে হারিয়েছিল রুনার সাথে আট বছর আগে একবার!
সবকিছু শেষ হয়ে গেলে মিজানের সম্বিত ফিরল...
একজন ভাঙাচুরা মানুষের মতো সে রুনার ফ্ল্যাটের সিড়ি দিয়ে টলতে টলতে নেমে এলো। সেখান থেকে সোজা নিজের বাসায় গেলো। এবং এখানেই সে ভুল করল। অসময়ে মিজানকে বাসায় আসতে দেখে ওর বউ রোমানা কিছুটা অবাক হল। তবে আজ তার স্বামীকে ওর কাছে কিছুটা উদ্ভ্রান্ত ও দিশেহারা লাগল। আর কাছে আসাতেই মিজানের শরীর থেকে মেয়েলী পারফিউমের হাল্কা ঘ্রাণ এবং ওর পোশাকে লিপস্টিকের দাগ দেখতে পেলো। তবে সে মাথা ঠান্ডা রাখলো। মিজানের ফ্রেস হবার অপেক্ষায় রইলো। এরপর ওকে জিজ্ঞেস করলো সরাসরি। মিজান কি বলবে বুঝতে পারলো না। শেষে মাথা নীচু করে বসে রইলো অনেকক্ষণ। সবশেষে রোমানাকে সবকিছু খুলে বললো। রোমানাও ঝিম মেরে বসে রইলো... ভাবলো... একবার চিন্তা করলো মিজানকে ছেড়ে চলে যায়... ওকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে। কিন্তু সেটা কোনো সমাধান হবে না ভেবে বিরত রইলো।এরপর মিজান এবং রুনার একজন খুব কাছের বন্ধু সায়মাকে ফোন করলো। দীর্ঘ আধা ঘন্টা ওর সাথের কথা বলল।
মিজানের সাথে ঐ ঘটনার পরেই রুনা কনসিভ করল।ওর সেই ডাক্তার বন্ধুর কাছে আবার গেল। সেখানেই পরীক্ষা করে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। বন্ধুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। সে মা হবে এটা বুঝতে পেরে একাধারে আনন্দ এবং দুঃখ দুটোই অনুভব করল। সে অনেক প্ল্যান করেই এই কাজটি করেছিল। এমনটিই চাচ্ছিল সে। নাফিসকে কিভাবে জানাবে এটা ভাবছিল। একটা কিছু তো ভেবে বের করতেই হবে।নাফিস ওর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছিল। প্রতিদিন আসতে রাত হয়ে যায়।আজ হঠাৎ করে দুপুরেই চলে আসাতে অবাক হল। অনেক গম্ভীর হয়ে বসার ঘরে সোফায় বসে রইলো। রুনা কাছে যেয়ে বসতেই একটু দূরে সরে গেলো নাফিস। অবাক হয়ে এই প্রথম রুনা নাফিসকে কেমন একটু ভয় পেলো। কি হয়েছে জানতে চাইলে নাফিস বলল, ' আমি তোমাকে ঘৃণা করি'। কেন করে জানতে চাইলে ধীরে ধীরে নাফিসের স্বভাবজাত স্থিরতায় মিজানের সাথে এই ক'মাসের সকল ঘটনা বলে গেল। সেখানে ক্ষোভ ও রাগের থেকে কষ্টটা বেশী প্রকাশ পেল। আজ নাফিসের অফিসে রোমানা এবং সায়মা এসে সব বলে গেছে।
রুনার জগতটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। সে কত কিছু ভেবে বসেছিল। আর কি হয়ে গেল। তারপরও নাফিসকে জিজ্ঞেস করল,
:আমি এখন কি করব? - নাফিস প্রথমে কোনো উত্তর দিলো না। তবে রুনা দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতেই এই প্রথম কিছুটা রাগের সাথে বলল, ' গো টু হেল'। দীর্ঘ আট বছরে নাফিস কখনো রুনার সাথে এমন ভাবে কথা বলে নাই। তবে সে নিজেও যে কাজটি করেছে তাতে এর থেকেও যে আরো কঠিন ব্যবহার তার প্রাপ্য সেটাও বুঝল। দুপুরের খাবার নাফিস খেলো না। রুনা ওকে একবার ডাকতে যেতেই সে নিজের রুমে ঢুকে ভিতর থেকে দরোজা বন্ধ করে দিলো। বেঁচে থাকার একটা দরোজা যেন ওর চোখের সামনেই কেউ বন্ধ করে দিল। দিশেহারা হয়ে মিজানকে ফোন করে। কিন্তু মিজান ওর ফোন ধরে না। দুবার রিং হবার পরে মোবাইল সুইচড অফ এটা জানায়। এরপর ফেসবুকে ওদের গ্রুপে ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনা। বন্ধুরা ওকে গ্রুপ থেকে রিমুভ করে দিয়েছে। মিজানও ওকে ব্লক করে দিয়েছে দেখতে পেলো।
ওর সব পথই বন্ধ দেখতে পেল... চকিতে একটা পথের কথা মনে হল।
ধীরে ধীরে ওর মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। একটা সাদা কাগজে নাফিসের উদ্দেশ্যে কিছু লিখে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।
বেশ জোরে শ্বাস টেনে ফুসফুসকে ভরিয়ে নিলো। পাহাড়ের একেবারে কিনারায় চলে এসেছে। পিছন ফিরে তাকালো। নাহ! কেউ নেই। আর থাকলেই বা কি? আর এক পা এগোলেই সুউচ্চ পাহাড় থেকে সে একেবারে নীচে পড়ে যাবে। জীবন-মৃত্যুর এই সন্ধিক্ষণে বিগত জীবনের সবকিছু দ্রুত একের পর এক চলে আসতে লাগল। মৃত্যুর সময় নাকি এরকমই হয়!
কিন্তু হঠাত 'মা' শব্দে সে চমকে উঠে...
পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। তবে সে স্পষ্ট শুনেছে ওকে 'মা' বলে কেউ ডেকেছে।
ওর অবচেতন মন ওকে সামনে বাড়তে বাঁধা দেয়। যে সত্ত্বাটি ওর শরীরের ভিতরে তৈরী হচ্ছে সে-ই ওকে বাঁধা দেয় সামনে বাড়তে। নিজেও চিন্তা করে ওর আর মিজানের মিলনের ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তার তো কোনো দোষ নেই। কেন সে ওর নিজের অপরাধে তাকেও মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে?
একজন দ্বিচারিণী স্ত্রী হবার সাথে সাথে এখন সে একজন মাও তো।
আর একজন মা কোনোভাবেই তার সন্তানকে মারতে পারে না।
রুনার আর মরা হল না। সে এবং তার সন্তান এই পৃথিবীর আলো-আঁধারি পরিবেশে জমে থাকা মায়ায় আরো কিছুকাল কাটাতে মনস্থ করল। মাটির সিড়ি দিয়ে নীচে নামার সময় ওর গলায় ঝুলানো মোবাইলের ব্যাগের ভিতরে মোবাইল বেজে উঠল।বের করে দেখে নাফিসের ফোন। একবার চিন্তা করল ধরবে না। আবার ভাবে শোনাই যাক না কি বলে। রিসিভ করতেই ওপাশে নাফিসের উদ্বিগ্ন গলা শুনতে পেল,
: রুনা, কোথায় তুমি?
: তোমার বলা 'হেল' এ।
: মজা কর না। আমি সব পড়েছি... তোমার কনসিভের কথাও জেনেছি...
: কিভাবে জানলে?
: মেডিকেল রিপোর্ট বাসায়ই রেখে গেছ তুমি। আমি সেখানের ডাক্তার যে তোমার বন্ধু তাকেও ফোন করেছি। সে-ই সব কিছু জানালো।
: সব কিছু মানে?
: আমাদের সন্তানের কথা!
নাফিসের মুখে 'আমাদের সন্তান' শব্দটা শুনে খুব ভালো লাগল রুনার। ওর ডাক্তার বান্ধবীর প্রতি নীরবে কৃতজ্ঞতা জানালো নাফিসকে আর বেশী কিছু জানায়নি দেখে। তবে একবার ভাবে এই সন্তানের আসল বাবার পরিচয় নাফিসকে বলে দেয়। কিন্তু তাতে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না ভেবে বললো না। আর নাফিস কি খুশী হয়েছে সেটা রুনা এখানে থেকেই ওর গলার স্বরে বুঝতে পারছে। কি লাভ নির্মম সত্য কথাটি বলে এই মানুষটাকে আরো কষ্ট দিয়ে? এই আট বছরে তো সে লোকটাকে স্বেচ্ছায় কোনোদিন ভালোবাসে নাই। আজ যখন সেই সুযোগটা এসেছে কেন সে দূরে সরে থাকবে? আর ওর ভিতরে যে সন্তান তিলে তিলে বড় হচ্ছে তাকেও কেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপহার দিবে সে?
: কই? বললে না কোথায় তুমি? নাফিসের প্রশ্নের উত্তরে রুনা বলল,
: এই তো আসছি!
আট বছর আগে এক আলোকোজ্জ্বল দিনে তার জীবনের যে আলো নিভা শুরু হয়েছিল, সেটা আজ মধ্যহ্নে একেবারে নিভতে নিভতে এসে এক বিষন্ন বিকেলে আবার আলোয় ঝলমল হয়ে উঠল!!
(শেষ)
বিষয়: সাহিত্য
১২৫১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক শুভেচ্ছা ব্লগে অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
কোনো কথা না বলে,
তোমার ভাষা বোঝার আশা
দিয়েছি জলাঞ্জলি'- চলুক তবে।
লেখককে ধন্যবাদ নয় লেখকের কলম হোক সকলের উসাহের প্রতীক!
ভালো লগালো ।
এতার উত্তর আপনাকে অন্য একটি মন্তব্যে ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছি।
আসলে সময় এসে যায় কিভাবে যেন।
অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন